ইমাম মালেক ইবনে আনাস (রা:) এর জীবনী

ইমাম মালেক ইবনে আনাস (রা:) ৯৫ হিজরী মোতাবেক ৭১৫ খৃষ্টাব্দে মদীনা মোনাওয়ারায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৭৯ হিজরী/৭৯৫ খৃষ্টাব্দ সালে সেখানেই বেসালপ্রাপ্ত হন। তিনি বলেন যে সত্তরজন ইমাম তাঁকে ফতোওয়া জারি করার তাকিদ দেয়ার পর তিনি তা দেয়া আরম্ভ করেন। তিনি আরও বলেন,

আমার শিক্ষকদের মধ্যে এমন খুব কম সংখ্যক-ই ছিলেন যাঁরা আমার কাছ থেকে ফতোওয়া নেননি।

ইমাম এয়াফী-ই বলেন যে ইমাম সাহেবের এই কথাটি বড়াই করার জন্যে বলা হয়নি, বরং তা আল্লাহতা’লার রহমত-বরকত প্রকাশের উদ্দেশ্যেই বলা হয়েছিল। ইমাম যুরকানী মালেকী ‘মুওয়াত্তা’ গ্রন্থের ওপর কৃত তাঁর শরাহ’র মধ্যে লেখেন:

ইমাম মালেক (রহ:) ছিলেন বিখ্যাত ইমাম আল-মযহাব; শীর্ষ স্থানীয় আলেমদের অন্যতম। তিনি ছিলেন সুতীক্ষ্ণ ধীশক্তি ও সুনৈতিকতার অধিকারী। রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর আহাদীসের তিনি-ই ছিলেন উত্তরাধিকারী। তিনি আল্লাহতা’লার ধর্ম তাঁরই সৃষ্টির মাঝে প্রচার-প্রসার করেন। নয়’শ উলামা-এ-হাক্কানী/রব্বানীর সান্নিধ্য লাভ করে তিনি ইসলামী জ্ঞানে সমৃদ্ধ হন। তিনি সংকলন করেন ১ লক্ষ হাদীস। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি শিক্ষা দান আরম্ভ করেন। তাঁর প্রভাষণ শুনতে আসা শ্রোতার সংখ্যা তাঁরই শিক্ষকদের প্রদত্ত প্রভাষণের শ্রোতা সংখ্যার চেয়ে বেশি ছিল। হাদীস ও ফেকাহ শিখতে শ্রোতারা তাঁর দরজার সামনে জড়ো হতো। এতে তাঁকে বৈতনিক একজন দারোয়ান নিয়োগ করতে হয়েছিল। প্রথমে তাঁর শিষ্যদের, তারপর সর্বসাধারণের প্রত্যেককে প্রবেশাধিকার দেয়া হতো। তিনি প্রতি তিন দিনে একবার হাউজে (গোসলখানায়) গমন করতেন। হযরত ইমাম বলতেন, ‘হাউজে দীর্ঘক্ষণ থাকতে আমি লজ্জাবোধ করি।’ ‘মুওয়াত্তা’ গ্রন্থটি লেখার সময় তিনি নিজের বিশ্বস্ততা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন। তিনি বইটি (হাউজের) পানিতে রাখেন। তিনি এ সময় বলেন, ‘যদি বইটি ভিজে যায়, তাহলে এর কোনো প্রয়োজন আর আমার কাছে থাকবে না।’ আশ্চর্য, বইটির কোনো অংশ-ই ভেজে নি।

আবদুর রহমান ইবনে আনাস (রহ:) বলেন,

হাদীসের জ্ঞানে ইমাম মালেক (রহ:)-এর চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য আর কেউই বর্তমান পৃথিবীতে নেই। তাঁর চেয়ে জ্ঞানী আর কাউকেই আমি দেখিনি। হযরত সুফিয়ান সাওরী (রহ:) হাদীসের একজন ইমাম, কিন্তু তিনি সুন্নাহ’র ইমাম নন। আল-আওযাঈ (রহ:) সুন্নাহ’র ইমাম, কিন্তু হাদীসের ইমাম নন। ইমাম মালেক (রহ:)-ই হাদীস ও সুন্নাহ উভয়েরই ইমাম।” ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ (রহ:) বলেন, “ইমাম মালেক (রহ:) হলেন দুনিয়ার বুকে আল্লাহতা’লার সৃষ্টিকুলের জন্যে মহান প্রভুর সাক্ষীস্বরূপ।

ইমাম শাফেঈ (রহ:) বলেন,

যেখানেই হাদীস অধ্যয়ন করা হবে, ইমাম মালেক (রহ:) সেখানে আকাশের তারকাসদৃশ। (এতদসংক্রান্ত) জ্ঞানের মুখস্থকরণ, উপলব্ধি ও সংরক্ষণে কেউই ইমাম মালেক (রহ:)-এর মতো হতে পারবেন না। আল্লাহ-সম্পর্কিত জ্ঞানেও কেউ তাঁর মতো আস্থাভাজন নন। আল্লাহ পাক ও আমার মাঝে সাক্ষী হলেন ইমাম মালেক (রহ:)। ইমাম মালেক (রহ:) ও হযরত সুফিয়ান ইবনে উবায়না (রহ:) না হলে এতোদিনে হেজায অঞ্চল থেকে জ্ঞান তিরোহিত হতো।

হযরত আবদুল্লাহ (রহ:) যখন তাঁর পিতা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)-কে জিজ্ঞেস করেন কে ইমাম যাহরী (রহ:)-এর শিষ্যদের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী, তখন তিনি জবাবে বলেন ইমাম মালেক (রহ:)-ই (ইসলামী) জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় সবচেয়ে বেশি জানেন। ইবনে ওয়াহহাব বলেন,

ইমাম মালেক (রহ:) ও লায়েস (রহ:) না হলে আমরা সবাই পথভ্রষ্ট হতাম।” ইমাম মালেক (রহ:)-এর নাম মোবারক যখনই আল-আওযাঈ (রহ:) শুনতেন, তৎক্ষণাৎ তিনি বলতেন, ”তিনি জ্ঞানীদের মাঝে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং মদীনা মোনাওয়ারার সেরা আলেম; আর তিনি মুফতী-এ-হারামাইন শরীফাইন-ও।

হযরত ইমামের বেসাল হওয়ার খবর শুনে হযরত সুফিয়ান ইবনে উবায়না (রহ:) বলেন,

তাঁর মতো কাউকে আর বর্তমানে ধারণ করে না এই পৃথিবী। তিনি ছিলেন এই দুনিয়ার ইমাম, হেজায অঞ্চলের আলেম, তাঁর সময়ের সাক্ষী এবং উম্মতে মোহাম্মদীয়ার সূর্যতুল্য পুণ্যাত্মা। আমাদেরও তাঁর পথে চলতে হবে।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) বলেন যে ইমাম মালেক (রহ:) হযরত সুফিয়ান আস্ সাওরী (রহ:), ইমাম লায়েস, ইমাম হাম্মাদ ও আল-আওযাঈ (রহ:)-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। হযরত সুফিয়ান ইবনে উবায়না (রহ:) জানান যে নিম্নের হাদীসটি ইমাম মালেক (রহ:)-কেই উদ্দেশ্য করে বিবৃত হয়েছে; মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান,

মানুষদের যখন (কারোর খোঁজ করা) জরুরি প্রয়োজন দেখা দেবে, তখন তারা মদীনায় অবস্থিত আলেমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কাউকে পাবে না।

ইমাম মালেক (রহ:) বলেন যে তিনি প্রতি রাতেই রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে স্বপ্নে দেখতেন। মুসা’আব বর্ণনা করেন তাঁরই পিতা হতে শ্রুত বাণী, যিনি বলেন,

ইমাম মালেক (রহ:) ও আমি একবার মসজিদে নববীতে অবস্থান করছিলাম। কেউ একজন এসে জিজ্ঞেস করেন আমাদের মধ্যে কে আবূ আব্দিল্লাহ মালেক (রহ:)। আমরা ইমাম সাহেবকে দেখিয়ে দেই। ওই ব্যক্তি তাঁর কাছে গিয়ে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে কপালে চুম্বন করেন। অতঃপর তিনি বলেন, ’আমি স্বপ্নে দেখেছি হুযূর পূর নূর (দ:) এখানে বসে আছেন। তিনি আদেশ দেন, মালেককে ডাকো। আপনি কাঁপতে কাঁপতে ছুটে আসেন। মহানবী (দ:) এরশাদ করেন, এয়া আবা আবদ-আল্লাহ, শান্ত হও! বসো এবং নিজ বক্ষ বিদীর্ণ করো! অতঃপর আপনার বক্ষ বিদীর্ণ হলে সর্বত্র সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।’ এ কথা শুনে ইমাম মালেক (রহ:) অনেক কাঁদেন। তিনি বলেন, এই স্বপ্নকে জ্ঞান হিসেবে ব্যাখ্যা করতে হবে।

20:44

Post a Comment

[blogger]

MKRdezign

TAGS

২০ রাকাত তারাবিহ (1) ৪ ইমামের জীবনী (4) ৭৩ দল (1) আমল (2) আল্লাহ ও রাসূল (ﷺ) কে ভালবাসা (2) আসমাউন নবী (ﷺ) (1) আহলুস-সুন্নাহ (2) আহলে কুরআন ফির্কা (1) ইনসান (1) ইবনে তাইমিয়্যা (1) ইমান (3) ইলমে গায়েব (1) ইসলামের ভিত্তি (1) উসীলা (8) এপ্সঃ আল আউলিয়া (54) ওহাবী (3) কবর ও মাযার জিয়ারত (2) কিতাবঃ ৪০ হাদিস মুখস্ত রাখার ফজিলত (41) কিতাবঃ আকাইদে আহলুস সুন্নাহ (7) কিতাবঃ ইসলামের মূলধারা [মঈনুদ্দীন আশরাফী] (21) কিতাবঃ উচ্চস্বরে জিকিরের বিধান [ইমাম সুয়ূতী] (2) কিতাবঃ নবীগণ (আঃ) স্বশরীরে জীবিত - ইমাম সুয়ূতী (রহঃ) (4) কিতাবঃ বিভ্রান্তির অবসান (16) কিতাবঃ মহানবী (ﷺ) নূর [হাদ্দাদ দামেশকী] (1) কিতাবঃ শাহ নেয়ামাতুল্লাহ (রহঃ)'র ভবিষ্যদ্বাণী (1) কিতাবঃ সালাফীদের জবাবে কালিমায়ে তাইয়্যেবাহ [ইকরাম উদ্দীন] (14) কিতাবুল ফিতান (1) কিয়াম (1) ক্বদরিয়া ফির্কা (1) খারেজী (3) জামাতে ইসলামের ভ্রান্ত আকিদা (2) জাহমীয়া ফির্কা (1) তরিকত (1) তাবলীগ (2) দাজ্জাল (1) দুরুদ (1) দেওবন্দী আক্বিদা (1) দোয়া কবুলের নিয়ম (1) নজদী (1) নারী (1) নিয়্যত (1) বাতিল ফির্কা (2) বায়আত গ্রহণ (3) মওদুদী মতবাদ (2) মক্কা মদিনার ফজিলত (1) মাক্বামে মাহমুদ (1) মাযহাব (13) মাযহাবের তাকলিদ (12) মাযার সম্পর্কিত (5) মিলাদুন্নবী (ﷺ) (1) মু'মিন (2) মুজরিয়া ফির্কা (1) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নবুওয়াত (1) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর পিতা-মাতা ইমানদার (1) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বন্টনকারী (1) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বেনজীর-বেমিসাল (1) লেখক ফোরাম (2) শবে বরাত (1) শানে আউলিয়া (20) শানে আহলে বাইয়াত (1) শানে মোস্তফা (ﷺ) (6) শানে সাহাবায়ে কেরাম (1) শাফায়াত (1) শিয়া (3) শিরিক (1) সদকায়ে জারিয়াহ (1) সালাত (7) সৌদি আরবের ইতিহাস (1) হক বাতিলের পরিচয় (2) হাদিস প্রচারে সতর্কতা (1)

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget